ধর্ষক ও হত্যাকারী এবং গোটা সিস্টেম, যা কিছু কোনো না কোনোভাবে সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যার সংস্কৃতিকে ধারণ ও বহন করে যাচ্ছে, তার প্রতি জানাচ্ছি তীব্র ঘৃণা ও নিন্দা। ভুক্তভোগী চিকিৎসক উল্লিখিত মেডিকেল কলেজে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেইনি ছিলেন এবং সেদিন রাতে তাঁর মেডিকেল ডিউটি পালন করছিলেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পারলাম, রাত দুইটার দিকে নারী চিকিৎসক বিশ্রাম নেওয়ার জন্য হাসপাতালের সেমিনার হলে গিয়েছিলেন। কারণ, সেখানে কর্তব্যরত নারী ডাক্তারদের জন্য কোনো অন কল বিশ্রামকক্ষ নেই, এমনকি নেই কোনো যথাযথ ওয়াশরুম।
একটি হাসপাতাল, যেখানে নারী চিকিৎসকেরা কাজ করেন, সেখানে রাতে কর্তব্য পালনকারী নারী চিকিৎসকের জন্য একটি বিশ্রামকক্ষ না থাকা নারী–অবান্ধব কর্মক্ষেত্রেরই দৃষ্টান্ত বহন করে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ থেকে যা জানা যায় তা থেকে আমরা বুঝতে পারি, কতটা নারকীয় ও নৃশংসভাবে মেয়েটাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল। ওই সেমিনার হলেই, যেখানে মেয়েটি নিতান্তই তাঁর কাজের ফাঁকে বিশ্রামের জন্য গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ, ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার জনতুষ্ঠিবাদী বয়ানগুলো অনেকটা একই রকম, যা ঘুরেফিরে মূলত ভিকটিম ব্লেমিংয়ে আবর্তিত হয়। নারীর পোশাক, রাতের চলাফেরা, একা চলাচল করা, ‘কেন ওখানে গিয়েছিল’—এসব ভিকটিম ব্লেমিংকেন্দ্রিক প্রশ্ন ঘুরে ঘুরে আনানো হয়, যেন নারী ও তার পরিবার সমাজ আরোপিত তথাকথিত ‘কলঙ্কের’ ভয়ে মুখ বন্ধ রাখে। ক্ষমতা খাটিয়ে আলামতও নষ্ট করা হয়। এখানে আর জি কর হাসপাতালেও যেমন আলামতগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য হামলা হয়েছে।
সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোতে নারীর অধস্তন অবস্থানকে ব্যবহার করে পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমে এই ভিকটিম ব্লেমিং এবং আইনের প্রক্রিয়াকে টেনে টেনে দীর্ঘায়িত করাটা আরও সহজ হয়ে যায়।
নারীর ক্ষমতায়নের যেসব ধারণা রয়েছে সেখানে দেখা যায়, নারীর শিক্ষা, অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা, পছন্দের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা তাকে সহিংসতা থেকে রক্ষা ও প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। একজন চিকিৎসক হয়ে এবং কলকাতার একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়াটা আমাদের এই ভাবনাকে নাড়া দেয়।
ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পর্যায়ে ক্ষমতায়িত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর সঙ্গে যেসব ধারণা ও সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই ধর্ষণের সংস্কৃতি, সেটাকে সমূলে নিষ্পেষিত করা প্রয়োজন।
আগেই বলেছি, আর জি কর হাসপাতালের কর্মক্ষেত্র নারীবান্ধব ছিল না বলেই মনে হয়। রাতে কর্তব্যরত নারী চিকিৎসকদের জন্য আলাদা ভালো বিশ্রামকক্ষ না থাকা সে প্রমাণই দেয়। তবে নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র শুধু অবকাঠামো বা স্পেসের ব্যাপারই নয়। বরং এর সঙ্গে রয়েছে প্রথমত একটি কর্মক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করছেন, অন্যান্য সহকর্মীর প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোকাঠামো ও আচরণ এবং দ্বিতীয়ত প্রতিষ্ঠানের নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক পলিসি ও তার যথাযথ প্রয়োগ।
এ বিষয়গুলো যেভাবে বিবেচনায় এনে প্রয়োগ করলে একটি প্রতিষ্ঠান নারীবান্ধব এবং যেকোনো জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যমুক্ত হতে পারে, দেশের কয়টি কর্মক্ষেত্র তা সঠিকভাবে করতে পারছে? বরং অসচেতনতা, প্রশিক্ষণের কমতি, সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক অবিশ্বাস পুরো প্রক্রিয়াকে কখনো কখনো প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, দক্ষিণ এশিয়াতেই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন।
যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করার জন্য একটি উপায় হিসেবে এখন কন্যাসন্তানকে আত্মরক্ষামূলক শারীরিক কৌশল শেখাতে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আন্তরিক হচ্ছে। তবে পাশাপাশি জনপরিসরে ও কর্মস্থলে তার (এবং পুরো নারীসমাজের) অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য, শিক্ষা, সচেতনতা নিয়ে নারী ও কন্যাসন্তানদের জোরেশোরে তৈরি হওয়া প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠান ও নীতিনির্ধারকদের আন্তরিক উদ্যোগ ও কঠোর তদারকি ছাড়া তা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন ২০১০ অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানে একটি কার্যকর অভিযোগ কমিটি গঠন করার কথা। কিন্তু দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেই এ কমিটি এখনো সচল নয়। কিংবা যতটুকু অভিযোগ আসে, তা চলমান হয়রানি ও যৌন সহিংসতার বর্তমান মাত্রার তুলনায় সামান্যই। অধিকাংশই ধামাচাপা পড়ে যায় নানাবিধ জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাত কারণে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেখাচ্ছে, বাংলাদেশে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের অতি ক্ষুদ্র অংশ তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেন।আর আইনের আশ্রয় নেন আরও কমসংখ্যক নারী।
অন্যদিকে ছেলেশিশুদের কেউ কেউ বড় হয়ে কীভাবে মেয়েশিশুর প্রতি সহিংস কিংবা ধর্ষক হয়ে ওঠে দিনে দিনে? কে বা কারা অথবা কী তাকে প্রতিনিয়ত শিখিয়ে চলেছে নারীর প্রতি সহিংসতাকে স্বাভাবিকীকরণ করতে? নিজের ক্ষমতা, প্রবৃত্তি অথবা প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তির জন্য ধর্ষণকে কেন সে বেছে নিচ্ছে? এই কারণ অনুসন্ধানে আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে থাকি পরিবার এবং পারিবারিক শিক্ষার ওপর।
প্রথম আলোতে ২০২০ সালে নোয়াখালীর এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও হত্যার পর লিখেছিলাম পারিবারিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে। আজ তার সঙ্গে যুক্ত করতে চাই এ প্রশ্নগুলো—পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে যে বড় প্রেক্ষাপটে ছেলেটি ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠে, সেখানে কোন পুরুষ এবং কোন ধরনের পৌরুষত্ব বেশি মূল্যায়িত হয়? বিদ্যায়তনে, কর্মক্ষেত্রে ও জনপরিসরে নারীর প্রতি কী দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে এবং কীভাবে?
বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপট, কর্মক্ষেত্র ও জনপরিসরের কাঠামো ও সংস্কৃতিতে যদি নারীর অধিকার, স্থান ও ন্যায্যতা সম্পর্কে সচেতন ও সক্রিয় থাকার চর্চা না করা যায়, তাহলে একজন কিশোর বা তরুণের জন্য শিখে আসা ইতিবাচক পারিবারিক শিক্ষার সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক হতে পারে। নারীকে অধস্তন অবস্থানে রাখা এবং তার প্রতি সহিংস আচরণ করা তার কাছে হয়ে যেতে পারে স্বাভাবিক এবং গ্রহণীয় একটি পুরুষালি আচরণ।
তাই সত্যিকারের জেন্ডার সংবেদনশীল (জেন্ডারবিষয়ক ন্যায্যতা ও সমতা বোঝা ও চর্চা করা) মানুষ তৈরির জন্য ব্যক্তি ও পরিবার থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও জনপরিসর ঢেলে সাজাতে হবে।
২০১৯ সালে নাইরোবি সম্মেলনে বৈশ্বিক তিনটি সমস্যাকে ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা তার মধ্যে অন্যতম। একে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে গেলে সহিংসতার ক্ষেত্রগুলো যেমন সঠিকভাবে চিহ্নিত করা জরুরি তেমনি জরুরি আইনি প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত, নিরপেক্ষ ও সহজীকরণ করা।
তার চেয়েও বেশি জরুরি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিমালা মেনে সর্বস্তরে নারীর নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ধর্ষণ ও সহিংসতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। এসবের জন্য চাই সবার সমন্বিত প্রয়াস।
0 Comments